নতুন বছরের ফ্যাশন ট্রেন্ড
গেল বছর পোশাকের কাট-প্যাটার্ন নিয়ে বেশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলো। দেশীয় তাঁতের পুনর্জাগরণের চেষ্টা ছিল। দেশীয় পোশাককে আন্তর্জাতিক রূপ দিতে চেয়েছিলেন ডিজাইনাররা। চলতি বছর ফ্যাশনে কী কী পরিবর্তন আসতে পারে, কেমন হতে পারে ফ্যাশন ট্রেন্ড—এ বিষয়ে ডিজাইনারদের সঙ্গে কথা বলেছেন পিন্টু রঞ্জন অর্ক
প্রিন্টের ব্যাপক চাহিদা থাকবে
শাহীন আহম্মেদ শীর্ষ নির্বাহী, অঞ্জন’স-
ফ্যাশন সব সময় পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। পরিবর্তনটা হয় ধীরে ধীরে।
হঠাত্ করে চোখে পড়ে না। কয়েক বছর পরে গিয়ে হয়তো মনে হয়, বড় একটি বদল ঘটে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে খেয়াল করছি, আমাদের এখানে ফ্যাব্রিকের ধরনটা বদলে যাচ্ছে। ক্রেতারা নতুন নতুন ফ্যাব্রিক চাচ্ছেন। ডিজাইনাররাও প্রতিনিয়ত নতুন ফ্যাব্রিক নিয়ে নিরীক্ষা করছেন। আরেকটা দিক বদলাচ্ছে, সেটা হলো কাট-প্যাটার্ন। এখন প্রিন্টের ব্যাপক প্রসার হচ্ছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, বহির্বিশ্বের ফ্যাশনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এ বছরও প্রিন্টের ব্যাপক চাহিদা থাকবে। আমাদের এখানে মেয়েরা মূলত তিন ধরনের পোশাক পরেন—শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ ও টপস বা সিঙ্গল কামিজ।
ইদানীং অনেকে আক্ষেপ করছেন যে শাড়ি পরা নাকি কমে গেছে। আসলে রেগুলার শাড়ি পরা হয়তো কিছুটা কমেছে; কিন্তু যেকোনো উত্সব-পার্বণ বা জন্মদিনের মতো ঘরোয়া কোনো অনুষ্ঠানের দিকে তাকালে দেখবেন শাড়ি পরেই হাজির হচ্ছেন তরুণীরা। সালোয়ার-কামিজ অনেক দিন ধরেই পরছেন মেয়েরা। এবার হয়তো সেটা কিছুটা কমবে। এর বদলে টপস বা সিঙ্গল কামিজে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন মেয়েরা। এর দুটি কারণ। প্রথমত, টপ বা সিঙ্গল কামিজ, লেগিংস, পালাজ্জো বা প্যান্ট যেকোনো কিছুর সঙ্গে অনায়াসেই পরা যায়। অন্যদিকে থ্রিপিসের চেয়ে এটা বেশ সাশ্রয়ী। যেকোনো অনুষ্ঠানে ছেলেদের পাঞ্জাবি পরার চল আছে। সেই ধারা অব্যাহত থাকবে। তবে রেগুলার ড্রেস হিসেবে শার্ট, টি-শার্ট, জিন্সের দিক থেকে মুখ ফেরানো কঠিন হবে। পোশাকের মোটিফ তো ইভেন্টকেন্দ্রিক। ঈদ, পূজাসহ বিভিন্ন উপলক্ষে লোকজ মোটিফের ব্যবহার বাড়বে।
ফিউশনের দাপট থাকবে
বিপ্লব সাহা ডিজাইনার, বিশ্বরঙ-
ফ্যাশনের দুটি ধারা—ট্র্যাডিশনাল ও ফিউশন। মানুষও এই দুই ধারায় পোশাক পরতে পছন্দ করে। একদল সব সময় পোশাকে ট্র্যাডিশনাল ধারা বজায় রাখার চেষ্টা করে। ফ্যাশন দুনিয়ায় যতটা হাওয়া বদলই ঘটুক না কেন, এতে তাদের যেন কিছুই আসে-যায় না। আরেক দল আছে, যারা সময়ের সঙ্গে নিজের বসন-ভূষণে পরিবর্তন পছন্দ করে। চলতি হাওয়ায় গা ভাসাতে আনন্দ পায় তারা। এই দলের বেশির ভাগই তরুণ। আমাদের এখানেও সেই ধারাটা অব্যাহত আছে। আগামীতেও থাকবে।
ফ্যাশনে এখন ফিউশনের জয়জয়কার। এটা আরো কয়েক বছর থাকবে। গেল কয়েক বছরের ফ্যাশনের দিকে তাকালে বোঝা যায়, পোশাকের চেয়ে বেশি পরিবর্তন এসেছে পোশাকের অলংকরণে ব্যবহূত নানা উপাদানে। আগামী বছরও তেমনটাই থাকবে।
আমাদের ফ্যাশন জগত্ মূলত ঈদ ও পহেলা বৈশাখ—এ দুই উত্সবকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। এসব উত্সবের সময়টায় আবহাওয়া বেশ উষ্ণ থাকবে। তাই একেবারে আঁটসাঁট নয়। একটু ঢিলেঢালা পোশাকের প্রতি আগ্রহ থাকবে তরুণ-তরুণীদের। গেলবার লেয়ার কাট বেশ দাপট দেখিয়েছে। এবারও সেই ধারা অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হয়। একেকটি পোশাকে অনেক ধরনের লেয়ার কাট থাকবে। ওড়নার বৈচিত্র্যময় ব্যবহার দেখা যাবে। শাড়ি নিয়ে নতুনভাবে ভাবছেন ডিজাইনাররা। সেই ভাবনার প্রতিফলন দেখা যেতে পারে। ছেলেদের স্লিমফিটও না আবার একেবারে ঢিলেঢালাও না, মাঝামাঝি অবস্থানে থাকবে পাঞ্জাবি। ফ্যাব্রিকের মধ্যে কটনের পাশাপাশি কাতান, সিল্ক, হাফ সিল্ক—এসব বেশ চলবে। এবার উত্সবের সময় থিমভিত্তিক পোশাকের বেশ চাহিদা থাকবে। একটা সময় পোশাকের মোটিফ নিয়ে আগে চিন্তা করা হতো। সেই অনুযায়ী প্যাটার্ন ঠিক করা হতো। এখন আগে প্যাটার্ন ঠিক করা হয়। তারপর মোটিফ। প্যাটার্ন নিয়ে অনেক ধরনের নিরীক্ষা দেখা যাবে। প্রকৃতিনির্ভর নকশার প্রতি মানুষের দুর্বলতা চিরকালীন। তাই গেলবারের মতো এবারও ফ্লোরাল মোটিফ, জিওমেট্রিক মোটিফের নানা ব্যবহার দেখা যাবে পোশাকে।
পোশাকে আরামের বিষয়ে গুরুত্ব দেবে সবাই
হুমায়রা খান ডিজাইনার, আনোখি-
নতুন বছরে তারুণ্যের ফ্যাশনে বেশ কিছু পরিবর্তন আসবে বলে মনে হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে ক্রেপ খুব দাপট দেখিয়েছিল। এবার সেটি আর থাকবে বলে মনে হয় না। তরুণীদের পোশাকে কোল শোল্ডারও (কাঁধের একটা দিক খোলা) বেশ চলেছিল। এবার কোল শোল্ডারের বদলে হাঁটু অবধি লম্বা কামিজ খুব চলবে। শর্ট কামিজের চাহিদাও কমবে না। পেনসিল প্যান্ট খুব দাপট দেখাবে। পাশাপাশি সারারা, লুজ প্যান্ট চলবে। চুড়িদার, আনারকলি, দোপাট্টা—এসব আবার ফ্যাশনে ফিরে আসবে। গেল বছর ফ্রিল খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এবারও সেই ধারা অব্যাহত থাকবে। আমাদের এখানে ফ্যাব্রিকসের অপশনটা কম। ঘুরেফিরে কয়েক ধরনের ফ্যাব্রিকস নিয়েই কাজ করতে হয়। নতুন পোশাক পরার ক্ষেত্রে আরামের বিষয়টি গুরুত্ব দেবেন ক্রেতারা। সেদিক থেকে জর্জেটের ব্যবহার কমবে। এর বদলে ভেষজ ম্যাটারিয়ালে বানানো কাপড়ের দিকে ঝুঁকবে মানুষ। এবার বেনারসি, কাতান শাড়ি খুব মাত করবে। ছেলেদের ফ্যাশনে শর্ট কলারের শার্ট, পাঞ্জাবি চলবে। ঈদের সময় লুজ প্যান্ট, স্টিচ প্যান্ট দেখা যেতে পারে। পোশাকে ছোট ছোট প্রিন্টের নকশা জনপ্রিয় হবে। কালারের মধ্যে প্যাস্টল কালার বেশ পছন্দ করবে সবাই।
গেলবার যা দেখা গেছে-
* দেশীয় তাঁতের পুনর্জাগরণের চেষ্টা ছিল। খাদি উত্সব ও বুনন উত্সবসহ বিভিন্ন আয়োজনে সেসবের কিছু নজির দেখা গেছে।
* ফিউশনধর্মী পোশাকের দাপট। তবে হুবহু পশ্চিমা ধাঁচে নয়, ডিজাইন বদলে দেশে পরার উপযোগী করেছেন ডিজাইনাররা।
* সুতি, সিল্ক, অ্যান্ডি সিল্ক, খাদি, মসলিন, তাঁত, জর্জেট প্রভৃতি কাপড়ের ব্যবহার বেশি হয়েছে।
* পালাজ্জো আর কুঁচির সালোয়ার ও কোল শোল্ডারের কামিজের চাহিদা ছিল।
* পোশাকে লোকজ মোটিফের ব্যবহার চোখে পড়েছে।
চলতি বছর যা দেখা যেতে পারে-
* মসলিন, জামদানি, খাদিসহ দেশীয় কাপড় নিয়ে নানামুখী গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। নতুন বছরেও সেটি অব্যাহত থাকবে।
* দেশীয় পোশাককে আন্তর্জাতিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা থাকবে ডিজাইনারদের। ফলে ফিউশনধর্মী পোশাক দেখা যেতে পারে।
* পোশাকে ডিজিটাল প্রিন্টের প্রাধান্য। শাড়িতেও ডিজিটাল প্রিন্টের নকশা থাকবে।
* জর্জেটের বদলে বেনারসি, কাতান শাড়ি জনপ্রিয় হবে।
* মেয়েদের লং প্যাটার্নের পোশাক। পালাজ্জোর বদলে পেনসিল প্যান্ট, চুড়িদার পায়জামা। ছেলেদের শার্টের আদলে পাঞ্জাবি দেখা যেতে পারে।
* পোশাকে গাঢ় রঙের প্রাধান্য থাকবে।
* ছিমছাম গয়না জনপ্রিয় হবে।
ডিজিটাল প্রিন্ট চলবে
এমদাদ হক ডিজাইনার ও উপদেষ্টা, আমব্রেলা-
এবার ডিজিটাল প্রিন্ট খুব চলবে। কারণ আন্তর্জাতিকভাবে ডিজিটাল প্রিন্টের পোশাক খুব জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। আমাদের এখানেও তার ঢেউ লাগবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বদলে যাচ্ছে ফ্যাশন। তরুণরাও এখন সেই বদলের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে। আর ডিজিটাল প্রিন্টের সুবিধাটা এখানেই—যেকোনো মোটিফ খুব সহজে ফুটিয়ে তোলা যায়। আরেকটি বিষয় দেখা যাবে, সেটা হলো হ্যান্ড এমব্রয়ডারির জায়গায় মেশিন এমব্রয়ডারি খুব গুরুত্ব পাবে এবং সেটি হবে ডিজিটাল প্রিন্টের পোশাকে। শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, টপ, কুর্তি থেকে শুরু করে সব ধরনের পোশাকেই ডিজিটাল প্রিন্টের নকশা দেখা যাবে। শাড়িতে একসময় ডিজিটাল প্রিন্টের কথা ভাবাই যেত না। এবার শাড়ির জমিন, আঁচল, পাড়—সব জায়গায় প্রিন্টের নকশা থাকবে। দেশীয় ঐতিহ্যের একটি আন্তর্জাতিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা থাকবে ডিজাইনারদের। নকশিকাঁথা, শীতলপাটি, মুখোশ, হাতপাখা, সন্দেশ, কান্তজির মন্দির, সোনারগাঁ, পানাম নগরসহ লোকজ মোটিফ ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলো ডিজিটাল প্রিন্টের মাধ্যমে পোশাকে তুলে ধরবেন ডিজাইনাররা। মেয়েদের লং প্যাটার্নের পোশাক বেশ চলবে। কামিজের সামনে-পেছনে লেয়ার নজর কাড়বে। পালাজ্জোর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়বে। তার বদলে চাপা প্যান্ট, চুড়িদার পায়জামার কদর বাড়বে। পাঞ্জাবির লুকে নানা পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। শার্টের আদলে পাঞ্জাবি তৈরি হবে। নেক লাইন, বর্ডার, পেল্ট—এগুলোতে ডিজিটাল প্রিন্টের ছোঁয়া থাকবে। ফ্লোরাল মোটিফ, জিওমেট্রিক্যাল ফর্ম নিয়ে পোশাকে নানা নিরীক্ষায় মাতবেন ডিজাইনাররা। রঙের মধ্যে লাল, কমলা, হলুদের মতো গাঢ় রংগুলোর দাপট থাকবে।
সূত্রঃ দৈনিক কালের কন্ঠ, ম্যাগাজিন
ছবিঃ সংগৃহীত